⏲ ভোর ৫:০৮ সোমবার
📆 ৮ পৌষ, ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

চৌধুরী মাশকুর সালাম:

যুদ্ধ, সংঘাত, এবং সহিংসতা—এই তিনটি শব্দ ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গী অংশ, যা মানবসভ্যতার বিকাশ ও অবক্ষয়ের মূল কারণগুলোর একটি। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম অগ্রগতি সত্ত্বেও, সংঘাত ও যুদ্ধের অবসান হয়নি। বরং, সময়ের সাথে সাথে এর প্রকৃতি এবং প্রভাব আরও জটিল ও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠেছে। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি শুধুমাত্র সংঘাত প্রবণ অঞ্চলগুলোতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, পরিবেশ, এবং মানবিক সংকটে এক অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করছে।

এই সংকটের বিশ্লেষণ এর প্রভাব ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে পর্যালোচনা এবং আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।

আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধের পর আমেরিকা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে এই যুদ্ধের সূচনা হয়। পুতিন সরকারের দাবি অনুযায়ী, এটি “বিশেষ সামরিক অভিযান।” তবে বাস্তবিক অর্থে এটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত হলেও এই যুদ্ধের উস্কানিতে ইউক্রেনের দায় ছিলো।

ইউক্রেনের পক্ষে রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। যুদ্ধের কারণে ইউরোপে জ্বালানি সংকট, খাদ্য দ্রব্যের সরবরাহে বিঘ্ন, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

বিশেষত, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই গম এবং ভোজ্য তেলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। ফলে, এই যুদ্ধ আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল একটি সমস্যা। ২০২৩ সালে স্বাধীনতাকামী হামাস মুক্তিযোদ্ধারা গাজা থেকে আকস্মিক হামলা চালালে ইসরায়েল পাল্টা অভিযান শুরু করে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় ব্যাপক আক্রমণ চালাচ্ছে, যার ফলে ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছে যাদের অধিকাংশই শিশু, নারী ও নিরপরাধ।

এই সংঘাত শুধু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি প্রভাবিত করছে। তাছাড়া, এটি ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষকে নতুন করে উসকে দিচ্ছে।

২০১১ সালে আরব বসন্তের নামে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আছাদের শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই বিদ্রোহ দ্রুতই আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপ নেয়।

এখনও পর্যন্ত সিরিয়ায় লক্ষাধিক মানুষ নিহত এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ার সংঘাত বিশ্বের অন্যতম মানবিক সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি সংঘাত হলো ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ। হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইয়েমেন সরকারের সংঘর্ষ ২০১৪ সালে শুরু হয়। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ও ইরানের প্রভাব এই সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে।

ইয়েমেনে খাদ্য সংকট, রোগব্যাধি, এবং দারিদ্র্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের মতে, এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত সুদান, ইথিওপিয়া, এবং কঙ্গোতে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। খনিজ সম্পদের দখল, জাতিগত বৈষম্য, এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা এই সংঘাতগুলোর মূল কারণ।

যুদ্ধের মূল মঞ্চে সবসময় সামরিক বাহিনী থাকলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ নারী, শিশু এবং নিরপরাধ মানুষ। তারা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিকার এবং এর ভয়াবহ প্রভাব তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভূত হয়।

যুদ্ধের সময় নারীরা নানা ধরণের সহিংসতার শিকার হয়। ধর্ষণ, অপহরণ, এবং যৌন শোষণকে অনেক সময় যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতে এই বাস্তবতা স্পষ্ট।

শিশুরা বিশেষভাবে অরক্ষিত। তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে এমন ক্ষতির শিকার হয় যা তাদের ভবিষ্যৎকে চরমভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত, যুদ্ধের সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

যুদ্ধের কারণে নারীরা তাদের বাড়িঘর হারিয়ে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। শরণার্থী শিবিরে তারা অপুষ্টি, রোগব্যাধি, এবং যৌন শোষণের শিকার হয়।

অনেক সংঘাতে শিশুদের অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় এবং তাদের যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এটি তাদের শৈশবকে ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।

যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ বোমা বিস্ফোরণ, ড্রোন হামলা এবং রাসায়নিক অস্ত্রের শিকার হয়। ইসরায়েল-গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এ ধরনের নিরপরাধ হত্যার একটি বড় উদাহরণ।

যুদ্ধের ফলে নারী ও শিশুদের মানসিক আঘাত চরমে পৌঁছায়। গৃহহীনতা, পরিবার বিচ্ছিন্নতা, এবং নিরাপত্তাহীনতা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।

যুদ্ধের পেছনে সাধারণত জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, এবং সামাজিক কারণ কাজ করে। এই কারণগুলো বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে।

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। যেমন—ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার নিরাপত্তার উদ্বেগ বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ধর্মীয় এবং জাতিগত বিদ্বেষ অনেক সময় সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন—তেল, গ্যাস, খনিজ পদার্থ—দখল করার প্রতিযোগিতা অনেক সংঘাতের কারণ। আফ্রিকার অনেক যুদ্ধের পেছনে এটি একটি প্রধান বিষয়।

দুর্নীতি, অদক্ষ নেতৃত্ব, এবং শাসনব্যবস্থার অভাব অনেক সময় দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। যেমন—সুদান এবং ইয়েমেনের সমস্যা।

যুদ্ধের প্রভাব

যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। বাড়িঘর হারানো, শরণার্থী হওয়া, এবং খাদ্য সংকট এই সংকটকে তীব্র করে।

যুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ভেঙে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে।

যুদ্ধের ফলে অনেক দেশের রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এটি বিদ্যমান সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করে।

যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশ আধুনিক অস্ত্র তৈরি এবং ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় নামে, যা বিশ্বে অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ায়।

যুদ্ধ পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যেমন—বোমা বিস্ফোরণ, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার, এবং তেলের ফাঁস।

যুদ্ধ নিরসনের পথ

সংঘাত নিরসনে কূটনীতি সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যস্থতায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।

দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব অনেক সময় যুদ্ধের মূল কারণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরি করে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী। তাই সংঘাত নিরসনে সকল দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে।

ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ দূর করতে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সঠিক তথ্য প্রচার এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব।

যুদ্ধ মানবতার জন্য এক চরম অভিশাপ। এটি শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে না; বরং নারীর সম্মান, শিশুর শৈশব এবং নিরপরাধ মানুষের জীবনের ওপর চিরস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মানবিক মূল্যবোধ এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসে, তাহলে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি সম্ভব। যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি, সহযোগিতা, এবং মানবিক উন্নয়নই হতে পারে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর প্রধান লক্ষ্যমাত্রা।

Muhurto 24 News
📆 আজ: সোমবার
🕐 সময় -ভোর ৫:০৮ - (শীতকাল)
◘ ৮ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
◘ ২০ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ - হিজরী