চৌধুরী মাশকুর সালাম: তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ১৯২৬ সালে মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) এর হাত ধরে ভারতের মেওয়ার অঞ্চলে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান ও চর্চা বৃদ্ধি করা। এই আন্দোলনটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।
বাংলাদেশে তাবলীগ জামাত কার্যক্রম শুরু হয় পাকিস্তান আমলে। ১৯৫০ এর দশকে এটি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত হয়। স্বাধীনতার পর, এটি বাংলাদেশে আরও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় এবং বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামিক আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগ জামাতের একটি বার্ষিক বৃহৎ সম্মেলন যা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। এটি প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে টঙ্গীতে। বিশ্ব ইজতেমা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত হজের পরে। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিমরা একত্রিত হন এবং তিন দিনের জন্য ধর্মীয় আলোচনা, দোয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের আত্মিক উন্নয়ন ঘটান।
বিশ্ব ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বৃদ্ধি করা এবং ইসলামের প্রকৃত বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। ইজতেমায় সাধারণত দাওয়াত ও তাবলীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর আলোচনা হয়, এবং এখানে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে ইসলামী শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারেন সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা পান।
তাবলীগ জামাতে গ্রুপিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাবলীগ জামাতের মধ্যে মূলত দুইটি গ্রুপ রয়েছে, যা বাংলাদেশে বিশেষভাবে আলোচিত। এই গ্রুপগুলো হলো ইজতেমার মূল ধারার অনুসারীরা এবং কাকরাইল মসজিদ কেন্দ্রিক একাংশ। এই বিভাজনের মূল কারণ হলো সংগঠনের নেতৃত্ব ও কিছু মতপার্থক্য।
সাদ পন্থি : এই গ্রুপটি মূলত মাওলানা সাদ কান্ধলভী (মাওলানা ইলিয়াসের বংশধর) এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এরা তাবলীগের শিক্ষা ও প্রথা অনুসরণে বিশ্বাসী এবং বিশ্ব ইজতেমার সময় এরা তাদের কর্মসূচি পরিচালনা করে।
আলেম পন্থি : এই গ্রুপটি তাবলীগ জামাতের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এদের নেতৃত্বে প্রবীণ আলেম এবং মুরব্বীরা রয়েছেন।
প্রধানত যে বিষয়গুলো এই বিভাজন সৃষ্টি করেছে
নেতৃত্বের পার্থক্য: তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের বিষয়ে মতপার্থক্য একটি প্রধান কারণ। মাওলানা সাদ কান্ধলভী এবং তার অনুসারীরা একটি পক্ষ হিসেবে পরিচিত, যেখানে প্রবীণ আলেম এবং মুরব্বীরা অন্য একটি পক্ষ গঠন করেছেন। এই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব অনেক সময় সংগঠনের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে।
মতাদর্শগত পার্থক্য : তাবলীগ জামাতের মূল আদর্শ এবং তার প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়েও পার্থক্য দেখা গেছে। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কোন পথে ইসলামের দাওয়াত কার্যক্রম পরিচালিত হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি : তাবলীগ জামাতের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বও একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের ভেতরে ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখা গেছে, যা গ্রুপিংয়ের পথ সুগম করেছে। এখানে ভারতীয় র’ এর যোগসাজশ থাকার অবকাশ রয়েছে। এর জন্য আওয়ামীলীগ নেতা এরতেজা হাসান এর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং পতিত অবৈধ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের মদদ ছিলো বলে ধারণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক প্রভাব : ভারতের তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত এবং তাদের প্রভাব বাংলাদেশে গ্রুপিংয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে বিশ্ব ইজতেমার সময় কোন পক্ষের নেতৃত্ব মেনে চলা হবে তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
তাবলীগ জামাতের মধ্যে গ্রুপিং অনেক সংঘাতের সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্ব ইজতেমার আয়োজনেও প্রভাব ফেলেছে।
তবে, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শান্তির জন্য এই সকল বিভাজন দূর করা জরুরি। ভবিষ্যতে, তাবলীগ জামাত কিভাবে আরও সুসংগঠিত ও সমন্বিতভাবে পরিচালিত হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা এবং সমাধান করা অতীব প্রয়োজন।