উসমান বিন আ.আলিম : পবিত্র মাহে রমজান। এই মাস নাজাতের মাস,নিজের জীবনের সকল পাপ মোচনের মাস,বরকতময় মাস, দু’আ কবুলের মাস।
এই বরকত ও ফজিলত পূর্ণ মাস হলো প্রতিটি মো’মেনের জন্য পূণ্য কামানোর উৎসবের মাস। এই রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হবে কোরআনুল কারীমের একটি আয়াত থেকে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকি-পরহেজগার হতে পারো। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই তার রোজা রাখে।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত : ১৮৩-১৮৫)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে,রোজা একজন বান্দার জন্য কতটা গুরুত্ব বহন করে এবং তা কতটা ফজিলতের।
রমজানের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে গোটা বছরের জন্য ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা এতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনিমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৩৬৮)
রমাজানের ফজিলত সম্পর্কে মুসলিম শরীফের আরো একটি হাদীসে কুদসী বর্ণিত হয়েছে; আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেছেন, ‘রোযা আমার জন্য, আর আমিই এর বদলা দিবো’(সহীহ মুসলিম- ২৭৬৪)
আল্লাহর তায়া’লার বদলা নিশ্চয়ই অতুলনীয়। তো এই ঘোষিত ফজিলত পূর্ণ মাস রমাযান মাস একজন মো’মেনের জন্য নেয়ামত স্বরূপ বিধায় প্রত্যেক মোমেনের জন্য নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা জরুরি। আর এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় তখনই হবে যখন একজন মো’মেন দুনিয়ার সকল মোহ ত্যাগ করে, সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে, এই মাসকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে।আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কার মনে করে পুরস্কার গ্রহণ করবে এবং সে এটাকে পূণ্য কামানোর মহা সুযোগ মনে করে পুরোপুরি আমলে লেগে যাবে।
সুতরাং এই পবিত্র রমাযান মাসে অধিক হারে নেক আমল করার চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য একান্ত আবশ্যক। বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে।
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত, রাসুল সা. তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভালো করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৭৪)
তাই এই ফজিলত পূর্ণ মাসে বেশি বেশি পূণ্য কামানোর জন্য নিম্নোক্ত আমল গুলো করা যেতে পারে।তাহলে এই মহিমান্বিত মাসের যথাযথ সম্মান হবে বলে আমি আশাবাদী।
রোজা রাখা: যা প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকার জন্য ফরজ।যার ফজিলত আমরা উপরে বর্ণনা করে এসেছি।
বেশি বেশি কোরআন খতম ও তেলাওয়াত করা: কেননা, এই কোরআন আপনার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। এবং প্রতিটি হরফে আপনি ৭০ নেকি করে পাচ্ছেন।এতেই আপনার পূণ্যের ভান্ডার জমে যাচ্ছে।
মহানবী সা. বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে।’ (আহমাদ, হাদিস: ৬৬২৬)
কিয়ামু রমাদান তথা তারাবি নামাজ আদায় করা: হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াব হাসিলের আশায় রমজানে কিয়ামু রমাদান (সালাতুত তারাবি) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি, হাদিস : ২০০৯)
এতে হাদীসের উপর আমল করে তারাবি নামাজও আদায় হয়ে গেলো।
তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা:
আমরা সাধারণত পুরো বছর তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার সুযোগ পাইনা । তো এই রমজান মাসে এই তাহাজ্জুদ নিয়মিত পড়ার একটা সুন্দর সুযোগ থাকে, তাই আমরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগাবো।প্রতিদিন সেহরি খাবার আগে বা পড়ে দুই রাকাআত বা চার রাকাআত করে পড়ে নিবো। আল্লাহর কাছে বেশি বেশি কান্নাকাটি করবো।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি, যিনি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম পালন করে, তার প্রথম পুরস্কার—রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৬)
শেষ দশকে ইতিকাফ করা:
আমল করার একটা সুবর্ণ সুযোগ হলো এতেকাফ করার মাধ্যমে। কারণ মসজিদে আমল করার মমনমানসিকতা ও পরিবেশ বজায় থাকে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৭১)
ওমরাহ আদায় করা:
রমজানে একটি ওমরা আদায় করলে অন্য মাসে ৭০টি ওমরাহ করার সওয়াব হয়। তাই এ মাসে ওমরাহ আদায় করাটাও অনেক বড় সওয়াবের কাজ। এ প্রসঙ্গে এক বর্ণনায় এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সঙ্গে হজ আদায়ের সমতুল্য।’ (মাজমাউল কাবির, হাদিস ৭২২; জামেউল আহাদিস, হাদিস : ১৪৩৭৯)
বেশি বেশি যিকির-আযকার করা:
আমরা তো অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেই অহেতুক কথাবার্তায়। ফেসবুক ও ইউটিউবে আড্ডাতে সময় নষ্ট করি। অথচ আমরা চাইলেই পারি ওই সময় গুলোতে তাসবীহ-তাহলীল করে কাটিয়ে দিতে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল-বিকেল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করো। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৪১-৪২)
নিজের সাধ্যমতো অন্যকে দান-সদকা করা:
রমজানের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দান-সাদকাহ করা। কারণ আমাদের প্রিয় নবীজি এই মাসে এ-কাজটি খুব বেশি বেশি করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁরা একে অন্যকে কোরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। (বুখারি, হাদিস: ৬)
এই কাজ গুলোর সাথে সাথে বেশি বেশি দোয়ায় গুরুত্ব দেওয়া:, বিশেষ করে ইফতারের সময়। হাদীসে এসেছে ‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৪৩)
এই পবিত্র রমজানে পূণ্য কামানোর সহজ উপায় যদি বলি তাহলে অনেক উপায় রয়েছে। বিশেষ করে সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, নিজে সহিহভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা এবং অন্যকে শিখানো, সময় মত সাহরী ও ইফতার করা, তাহাজ্জুত নামাজ পড়া, দুরুদ শরীফ পাঠ করা, বেশি বেশি দান সদকা করা, ইতিকাফ করা। এরকম আরো অনেক পূণ্য কাজ রয়েছে সেগুলোকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করা।
আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও সঠিকভাবে আমল করার মাধ্যমে এই মহিমান্বিত রমাদান মাসে পরিপূর্ণ পূণ্য কামানোর তৌফিক দান করুক, এবং জান্নাত লাভের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার তৌফিক দান করুক,আমিন।
লেখক: মোহাদ্দেস ও গবেষক, জামি’আ ইসলামিয়া আরাবিয়া।বলিয়ারপুর, সাভার,ঢাকা।
মু/মু